শিরোনাম

বিপিএলে ফিক্সিং ইস্যুতে তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) সর্বশেষ আসরে ওঠা স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্বাধীন তিন সদস্যের কমিটি গত কয়েক মাসে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেছে। তাদের রেকর্ডকৃত কথোপকথনের সময় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ ঘণ্টা, যা লিখিত আকারে তিন হাজার পৃষ্ঠারও বেশি হয়েছে। সেখান থেকে প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরির কাজ শেষ, আর আগামী সপ্তাহখানেকের মধ্যে বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলামের কাছে জমা পড়বে সেই রিপোর্ট।
বিসিবি গত ফেব্রুয়ারিতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। নেতৃত্বে ছিলেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. খালেদ এইচ চৌধুরী এবং সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাসেম। ড. খালেদ জানিয়েছেন, প্রাথমিক রিপোর্টের মূল লক্ষ্য হলো বিসিবিকে সতর্ক করা এবং আসন্ন বিপিএল মৌসুমে যেন একই ধরনের অনিয়ম বন্ধে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া।
সন্দেহভাজন খেলোয়াড় ও ঘটনাপ্রবাহ
শুধু গত আসরেই সন্দেহজনক ঘটনা ধরা পড়েছে অন্তত ৩৬টি। তদন্তে উঠে এসেছে ১০–১২ জন ক্রিকেটারের নাম, যাদের মধ্যে ৩–৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশ স্পষ্ট। এদের ‘হাই ফ্ল্যাগড’ ধরা হচ্ছে। তাদের মধ্যে জাতীয় দলে খেলা দুই ক্রিকেটারও আছেন, একজন পেসার ও একজন অফ স্পিনার। আরও আছেন জাতীয় দলে না খেলা এক পেসার, যিনি অস্বাভাবিক ওয়াইড বল করে আলোচনায় এসেছিলেন। বাকিরা ‘মিডিয়াম’ ও ‘লো ফ্ল্যাগড’ ক্যাটাগরিতে আছেন, অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ একেবারে নিশ্চিত না হলেও নির্দোষ বলা যাচ্ছে না।
অভিযুক্ত খেলোয়াড়
অভিযুক্তদের বেশির ভাগই ৩৫ পার হয়ে যাওয়া ক্রিকেটার, যাদের জাতীয় দলে ফেরার সম্ভাবনা নেই। তবে তালিকায় আছেন সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা সফরের দলে থাকা একজন ক্রিকেটারও। পাশাপাশি একজন ফ্র্যাঞ্চাইজির কোচ এবং বিসিবির একটি সাব-কমিটির সদস্যের নামও উঠে এসেছে। ফলে তদন্তের ব্যাপ্তি শুধু খেলোয়াড় নয়, কোচিং স্টাফ ও কর্মকর্তাদের দিকেও গড়িয়েছে।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ও ম্যাচে অনিয়মের ইঙ্গিত
কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত হয়েছে যে অন্তত তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজি দুর্বার রাজশাহী, সিলেট স্ট্রাইকার্স ও ঢাকা ক্যাপিটালস সর্বশেষ আসরে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিদেশি বোলারকে হঠাৎ করিয়ে দেওয়া বা এমন খেলোয়াড় ব্যবহার, যারা আগের দিনই বাংলাদেশে এসে পরদিন মাঠে নেমেছেন। এসব ঘটনায় ফলাফল প্রভাবিত হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
সম্প্রচার ও বেটিংয়ের প্রভাব
তদন্তে সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকেও আঙুল উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, যেসব টেলিভিশন চ্যানেলে অনলাইন বেটিংয়ের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে, তারা পরোক্ষভাবে ফিক্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। শুধু বিজ্ঞাপন প্রচার করেই একটি প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে ১৭০–১৮০ কোটি টাকা তুলেছে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি দেখা গেছে, অনেক বেটিং এজেন্ট করপোরেট বক্সে বসে ম্যাচ দেখার সুযোগ পেয়েছেন, যেখানে দুর্নীতি দমন ইউনিটের নজরদারি ছিল না।
আগের আসরগুলোতেও অনিয়ম
যদিও তদন্তের লক্ষ্য ছিল সর্বশেষ বিপিএল, কিন্তু প্রক্রিয়ায় আগের চার আসরেরও অনেক সন্দেহজনক ঘটনা সামনে এসেছে। মোট ১৪০টিরও বেশি ঘটনায় অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৬০-এর বেশি খেলোয়াড়ের নাম এসেছে সন্দেহভাজন হিসেবে। একাধিক খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে। ২০২৩–২৪ আসরে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে একটি ম্যাচ হারতে জুয়াড়িরা ৪০০ কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিল বলেও তথ্য এসেছে।
সুপারিশ ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার সুপারিশ করবে। ঘরোয়া লিগসহ সব আসরেই নজরদারি চালু রাখার প্রস্তাব থাকবে। সম্প্রতি বিসিবি ইউনিটের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে আইসিসির সাবেক কর্মকর্তা অ্যালেক্স মার্শালকে। পাশাপাশি অনলাইন বেটিং ঠেকাতে বিদ্যমান আইন সংস্কার বা নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ থাকবে, যাতে বিসিবি নিজেরাই আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।
তদন্তে প্রতিবন্ধকতা ও ফরেনসিক প্রয়োজন
একটি বড় অভিযোগ হলো, বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিট স্বাধীন তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করেনি। আইসিসি এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যও তারা যথাযথভাবে দেয়নি। তাছাড়া ফরেনসিক তদন্তের এখতিয়ার না থাকায় অভিযুক্তদের আর্থিক লেনদেন খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। রিপোর্টে ফরেনসিক তদন্তের সুপারিশও করা হবে।
আরও পড়ুন: